চিত্তরঞ্জন লোকো মোটিভ কারখানা (Chittaranjan Locomotive Works – CLW) ভারতের অন্যতম বৃহৎ এবং ঐতিহাসিক রেল ইঞ্জিন নির্মাণ কেন্দ্র। পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম বর্ধমান জেলার এক জনবিরল বনাঞ্চলে এই কারখানার সূচনা হয় স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে, দেশের আত্মনির্ভর শিল্পায়নের স্বপ্ন নিয়ে। নিচে এই ঐতিহাসিক কারখানার গড়ে ওঠার ধারা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো:
🇮🇳 স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের শিল্পায়ন ও CLW-এর জন্ম:
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর ভারতের প্রথম লক্ষ্য ছিল আত্মনির্ভরতা। রেল পরিবহন ছিল দেশের অর্থনৈতিক রক্তসঞ্চালন, অথচ রেল ইঞ্জিন তখনও আমদানিনির্ভর। সেই প্রেক্ষিতে, ১৯৫০ সালে চিত্তরঞ্জন-এ রেল ইঞ্জিন কারখানা গড়ে তোলার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়।
- কারখানার প্রথম নাম ছিল Locomotive Manufacturing Works।
- পরে এটি দেশের বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী চিত্তরঞ্জন দাশ-এর নামে নামাঙ্কিত হয়ে হয় Chittaranjan Locomotive Works (CLW)।
- উদ্বোধন করেন ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ, ২৬ জানুয়ারি, ১৯৫০।
📍 স্থান নির্বাচন: বনকাঠি থেকে চিত্তরঞ্জন
এই কারখানা গড়ে ওঠে ‘বনকাঠি’ নামক একটি অরণ্য ও জনশূন্য এলাকায়। কারণ ছিল:
- পর্যাপ্ত জমি
- খনিজ সম্পদের নিকটতা (আসানসোল অঞ্চলে)
- জল, বিদ্যুৎ, পরিবহন সুবিধা
- সহজে শ্রমিক নিয়োগ
এই এলাকাই পরবর্তীকালে হয়ে ওঠে চিত্তরঞ্জন শহর — একটি পরিকল্পিত, পরিচ্ছন্ন, সবুজ শিল্পনগরী।
🛤️ রেল ইঞ্জিন নির্মাণের সূচনা:
- CLW-এ তৈরি প্রথম রেল ইঞ্জিনের নাম ছিল “ডেস্কো” (Deshbandhu Chittaranjan)।
- ১৯৫০ সালে এটি নির্মিত হয় এবং এর মাধ্যমে ভারতীয় রেল ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটে।
- পরবর্তী দশকে স্টিম ইঞ্জিন থেকে ডিজেল এবং ইলেকট্রিক ইঞ্জিন নির্মাণ শুরু হয়।
🏭 শহরের বিকাশ:
চিত্তরঞ্জন শহর মূলত কারখানাকে ঘিরেই গড়ে ওঠা এক পরিকল্পিত নগর। এর বৈশিষ্ট্য:
- বিভিন্ন টাইপের কর্মী আবাস (A, B, C কোয়ার্টার)
- নিজস্ব বিদ্যালয়, হাসপাতাল, বাজার, বিনোদনকেন্দ্র
- পরিচ্ছন্নতা, সবুজায়ন ও নিরাপত্তায় রেল কর্তৃপক্ষের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ
এটি দেশের অন্যতম পরিচ্ছন্ন শহর হিসেবে পরিচিত।
👷 শ্রমিক সংখ্যা ও উৎপাদন ক্ষমতা:
- প্রাথমিক পর্যায়ে (১৯৫০): ১০,০০০–১২,০০০ শ্রমিক
- সর্বাধিক নিয়োগ (১৯৭০–৮০): ৩০,০০০–৩৫,০০০ শ্রমিক
- বর্তমান (২০২৫): ১০,০০০–১১,০০০ শ্রমিক
অটোমেশন ও প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে কম শ্রমিকে বেশি উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে।
🏁 উপসংহার:
চিত্তরঞ্জন লোকো মোটিভ কারখানা কেবল একটি রেল ইঞ্জিন নির্মাণ কেন্দ্র নয়, বরং এটি ভারতীয় শিল্প ইতিহাসের এক গর্বের অধ্যায়। এটি একটি শহরের জন্ম দিয়েছে, হাজার হাজার মানুষের জীবিকা নিশ্চিত করেছে, এবং দেশের রেল ব্যবস্থাকে শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করিয়েছে। চিত্তরঞ্জনের ইতিহাস জানলে বোঝা যায়, কীভাবে একটিমাত্র প্রকল্প একটি গোটা জনপদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে।
এই ইতিহাস শুধু গর্বের নয়, ভবিষ্যতের জন্যও প্রেরণার।